“পলাশবাণী কলকাতা” – পলাশ সেনের কলকাতা-দর্পণ

[ আমার বন্ধু ও জীবন-নির্দেশক পলাশ সেনের কলকাতা প্রেম আমার মধ্যে সংক্রামিত হয়েছিল। ইতালীর নেপলসে চিরতরে স্বেচ্ছা-নির্বাসনের আগে তার “কলকাতা নোট” তিনি আমাকে দিয়ে যান। সেই নোট আর ভ্রমণের ফল হল ইংরেজীতে লেখা কড়চা – Calcutta Culture Glossary। পলাশ সেন পয়ত্রিশ বছর বয়সেই প্রথম যৌবনের মিতাচার, বন্ধু-প্রীতির দৌলতে তার জীবিকার সমস্যার সমাধান করেন। নববই দশকের শেষের দিকে তিনি আজকের কয়েকটি জগদ্বিখ্যাত আই-টি কোম্পানীতে নিউ-ইয়র্কের এক বন্ধুর মাধ্যমে টাকা লাগান। নিউ-ইয়র্কের ডলার, কলকাতার অবসরস্নিগ্ধ বুদ্ধি। তার বন্ধুটিও লাভবান হন। সরকারী চাকুরী ত্যাগ ও মুক্তপুরুষ পদবী লাভ। স্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবী ততদিনে পলাশ সেনের মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে দাম্পত্য কলহের শেকড় নাশ করেন। পরবর্তী দশ বছর তিনি কলকাতার “নিবাসী-দর্শক-সাক্ষী-ভোক্তা” হিসেবে কাটান। সেই সময় তার সঙ্গে আমার পরিচয় আর নিবিড় বন্ধুত্ব। ]


টালিগঞ্জে বিড়ম্বনা : একদিন সকালে এক বাসে চেপে বসলুম, কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই। পাশে বাঁদিকে এক মহিলা, তার চেহারা ভালো মনে নেই কিন্তু গলার স্বর মনে করে এখনো চাঞ্চল্য হয়। পশ্চিমবঙ্গীয় স্বর, “ল” আর “ট” তে পূর্ববঙ্গীয় প্রবল শ্বাসাঘাত নেই। অনুপ্রাস বর্ণগুলি যেন আদর পাচ্ছে। ইনি ফোনে কথা বলছেন। সংক্ষেপে শ্রীমতি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের “মধু মালতী ডাকে আয়”-তে যে কুহকের ডাক আছে, সে রকম। বাস পেরিয়ে গেল বেকবাগান, বালিগঞ্জ, যাদবপুর – হঠাৎ মহিলা নামলেন। আমি যন্ত্রের মতো নামলাম। কোন এক গলিতে সম্মোহিতের মতো তার পেছনে – হঠাৎ সে ঘুরল – “আপনি কি আমাকে ফলো করছেন ?” হ্যাঁ, সে কোন এক গলি দিয়ে চিরকালের মতো হারিয়ে গেল।

কলকাতার অটোর ঝগড়া: একদিন কি এক তুচ্ছ কারনে দুই যাত্রীর অটোর ঝগড়া। প্রবীণ ও নবীনে। আমি ছেলেটিকে বললাম – আচ্ছা আমাদের মূল সমস্যা কিন্তু অটো, কলকাতা, কলকাতার লোক নয়। ধরো আজকে যদি তোমাকে বা সেই ভদ্রলোককে চাকরী বা কাজের জন্য বেরোতে না হত, তবে দেখার সম্ভাবনাই ছিল না। আমাদের যদি এরকম বন্দোবস্ত হত যে এই অটোয় অফিসে গিয়ে বসের মুখে দেখার বদলে গোয়ার চার্টার্ড ফ্লাইটে এয়াহোষ্টেসের ওয়েলকাম ড্রিংক আর পরে বীচে “ফুলটুস মস্তি” ! তুমি কি এর সঙ্গে ঝগড়া করতে ? ছেলেটি কিছু বলল না, একটু ভেবে বলল, এবার হেসে – আমি গোয়া না গিয়ে কিন্তু মন্দারমণি যাব।

ব্যথা কমানোর সেলসম্যান : “উঠতে গেলে লাঠি আর বসতে গেলে মাটি”

ছুটির দিনগুলি : উত্তর কলকাতার এক দোকানে কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করলাম : আপনাদের ছুটি কবে ? উত্তর : “দোলে, না এলে আর ম’লে”

WBMS : তখন সল্টলেকের কোন এক পার্কের কাছে এক চা-ওয়ালার কাছে চা খেতে গিয়ে দোকানী বলছে – “জানিস, আমি কত বড়ো সংঘটনের মাননীয় সদস্য ?” কোন সংঘটন ? উত্তর : ওয়েষ্ট বেঙ্গল মাতাল সমিতি।


প্রবাসী পুত্রদের বিরক্ত পিতা : সল্টলেকের একটি বাজারের ভেতরের সেলুন। এক বৃদ্ধ দাড়ি কামাচ্ছেন। ছোকরা নাপিতটি রসিক – সে বললে – কাকীমার শরীর ঠিক আছে ত? আরে, ঠিক নেই, আমি আর একা কত দেখব ? ছেলেগুলো আসেই না (দু্ই ছেলেই প্রবাসী, অতি মেধাবী ও প্রতিষ্ঠিত)। বুঝলি এখন ভাবি, এদের এত লেখাপড়া না শেখালেই হয়তো ভালো ছিল। পরে, নাপিতটি আমায় বলল : “বৃুড়ো-বুড়িকে গ্যারেজ করে দিয়েছে।”


পুরোনো কমিউনিষ্ট বাঙ্গালী বৃদ্ধ : আমেরিকা প্রবাসী পুত্র-পুত্রবধুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ সফল বাঙ্গালী পিতা। আমি প্রশ্ন করলাম – আচ্ছা, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অবস্থা কিরকম দেখলেন ?  অবস্থা কিরকম ? “ধুর, অসব কমবয়সের কথা ছাড়ো ত। এই দ্যাখো – মোজারেলা চীজ, খাও, একদম ওরিজিনাল মাল। চেখে দ্যাখো। আমি বল্লাম – “বহোত খুব ! শুধু একটু সাম্রাজ্যবাদের গন্ধ আসছে।” বৃদ্ধ অট্টহাস্যে তার যৌবনের অবিমৃষ্যকারিতাকে উড়িয়ে দিলেন।

পলাশবন্ধু

“পলাশবাণী কলকাতা” – পলাশ সেনের কলকাতা-দর্পণ – ২

[ আমার বন্ধু ও জীবন-নির্দেশক পলাশ সেনের কলকাতা প্রেম আমার মধ্যে সংক্রামিত হয়েছিল। ইতালীর নেপলসে চিরতরে স্বেচ্ছা-নির্বাসনের আগে তার “কলকাতা নোট” তিনি আমাকে দিয়ে যান। সেই নোট আর ভ্রমণের ফল হল ইংরেজীতে লেখা কড়চা – Calcutta Culture Glossary। পলাশ সেন পয়ত্রিশ বছর বয়সেই প্রথম যৌবনের মিতাচার আর বন্ধু-প্রীতির দৌলতে তার জীবিকার সমস্যার সমাধান করেন। নববই দশকের শেষের দিকে তিনি আজকের কয়েকটি জগদ্বিখ্যাত আই-টি কোম্পানীতে নিউ-ইয়র্কের এক বন্ধুর মাধ্যমে CPF-র টাকা লাগান। নিউ-ইয়র্কের ডলার, কলকাতার অবসরস্নিগ্ধ বুদ্ধি। তার বন্ধুটিও লাভবান হন। সরকারী চাকুরী ত্যাগ ও মুক্তপুরুষ পদবী লাভ। স্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবী ততদিনে পলাশ সেনের মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে দাম্পত্য কলহের শেকড় নাশ করেন। পরবর্তী দশ বছর তিনি কলকাতার “নিবাসী-দর্শক-সাক্ষী-ভোক্তা” হিসেবে কাটান। সেই সময় তার সঙ্গে আমার পরিচয় আর নিবিড় বন্ধুত্ব। ]


কোটি-অক্ষৌহিণী :  একবার একটি সভায় গেছি – উদ্যোগীদের সভা। এক বাঙ্গালী উদ্যোগপতি বললেন – “আমি বাঙ্গালীকে NRI বানাই”, মানে, ইনি বিদেশে ছাত্র ও চাকুরীপ্রার্থী সাপ্লাই করেন । আমি অবাক হয়ে গেলাম, তখন সদ্য কলকাতায় এসেছি। “ম্যাকনামারা গো ব্যাক: থেকে ম্যাকনামারার দেশের বহু-বাঞ্ছিত NRI বানানোর শিল্প। আরেক বাঙ্গালী, বলিয়ে কইয়ে লোক, লক্ষ-কোটি বিনিয়োগের কথা বলতে লাগলেন। আমি বললাম – “আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ, হার্টের ব্যারাম আছে, ডাক্তার উত্তেজিত না হতে বলেছেন – লক্ষ-অর্বুদ-অক্ষৌহিণী অংক শুনতে বারণ করেছেন।” উদ্যোগপতি অপ্রসন্ন হলেন আর পাশের ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করতে লাগলেন।

মেকলের ক্লাব : কলিকাতায় ইদানীং মেকলে (লর্ড ব্যাবিংটন মেকলে) খুব নিন্দিত না হলেও প্রশংসিত নন। কলিকাতার একটি অতি অভিজাত ক্লাবে ( যা মেকলের বাড়ী এককালে ছিল, নিশ্চিন্ত আমিও নই, ঐতিহাসিকরাও নন) একটি সভায় গেলাম, আমার বন্ধুর সৌজন্যে। বাঙ্গালী-অ-বাঙ্গালী সকলেই ইংরেজীতে ভাষণ দিলেন। শেষে গানের সময়ও ইংরেজী গান – আমি ভাবতে লাগলাম – আমরা কি “মেকলের চিল্ড্রেন” নই ?

কলকাতার ক্লাব : কলিকাতায় এক বিদেশী রাজদূত স্তরেরলোকের সঙ্গে আমার আলাপ ছিল। একবার তিনি এক ক্লাবে আমাকে নিমন্ত্রণ করলেন – আমি অস্বীকার করলাম আর লিখে জানালাম কেন। আমার মূল বক্তব্য ছিল যে কলকাতার জলবায়ু-আবহাওয়ায় “ক্লাব” আরোপিত জিনিষ। কলকাতায় কোন পিয়াৎজা নেই – উন্মুক্ত des’planade, বাগান যেখানে অনেক রাস্তা মিশেছে, বিকেলে সেই গোল চক্করে পুরো শহর দেখা যায় – সেরকম বিশুদ্ধ নগর-স্থাপত্য কিছু নেই । ব্রিটিশরা হয়ত ভেবছিল যে আমরা এখানে অযুত-নিযুত বছর আছি আর ততদিনে ক্লাইমেট চেঞ্চ, বরফ-যুগ পার করে কলকাতার আবহাওয়া লন্ডনের মতো হবে আর মাথায় ঘামের বদলে আমাদের ওলবাটা মুখ হবে।  রাজপুরুষ জবাব দেন নি কিন্তু আর কোনদিন ক্লাবে নেমন্তন্ন করেন নি – একবার তার বাড়ীতে নেমন্তন্ন করেছিলেন।

ইডেন উদ্যানের দারোয়ান :  ইডেন উদ্যানের এক দারোয়ানের সঙ্গে আমার ভালো আলাপ আছে। আমার একটি শখের মধ্যে একটি হল ইডেনে বসা – খালি মাঠ আর ভেতরের খাবার -ডেভিল আর কারি। প্রেমিক যেমন মৃতা প্রেমিকার সমাধির কাছে চুপচাপ বসে থাকে, আমারও সেরকম। আমি গাভাসকর, কপিল দেব, ষ্টিভ ওয়া, ইয়ান বোথাম, ভিভ রিচার্ডস, মহিন্দর অমরনাথ, ইমরান খানের ইডেন আর কীর্তির কথা ভাবি – সেই ক্রিকেটসুন্দরী আজ মৃত। মদের ব্যবসায়ী, অন্য ব্যবসায়ী, বলিউডি অভিনেতা-অভিনেত্রী, তৃতীয় বিশ্বের হঠাৎ অবতার ধনী এরা আজ “টিম” বেচা-কেনা করে। ইডেন যেন রোমান এমফিথিয়েটার – চারদিকে দর্শক না রোমান মব, ধনবান  “মালিকরা” ষ্ট্যান্ডে নেশাগ্রস্ত, জুয়াড়ীদের আনাগোনা, গ্ল্যডিয়েটর, ক্রিকেটার নয়। বৃদ্ধ দারোয়ান এসে বলল – “বাবু, গেট বন্ধ করব, এবার যে বেরোতে হবে ।” বেরোনোর সময় বৃুড়ো দারোয়ান আমাকে বলল : জানেন বাবু, স্যার গেরী সোবার্সের সঙ্গে আমার আলাপ ছিল। আমাকে একবার জামাইকার রম খাইয়েছিলেন, চল্লিশ বছরের আগের কথা। আমি বললাম, এখন ? সে লোক আর নাই। ঠিক, সে লোক আর নাই।

চুম্বক ও চুম্বন : বাংলা ভাষার এই দুটি শব্দ নিয়ে আমার এক বন্ধুর কাহিনী। সে নিজেকে বলত “Calcutta boy” – অকালমৃত। ম্যাডান ষ্ট্রীটের একটি দোকানে সায়েন্সের প্র্যাকটিকাল জিনিষ কেনা যেত। একবার সে আমাকে নিয়ে যায়, তাতে ভারী মিষ্টি একটি সেলস্-গার্ল ছিল। তখন বয়স আঠারো। দোকানে গেলে মেয়েটি জিজ্ঞেস করল – “কি চাই?”, বন্ধু -“একটা চুম্বন চাই”, মেয়েটির চোথ কপালে উঠল…বস্ধু এবার স্পষ্ট বলল – চুম্বক চাই, দুই হাতের বুড়ো আঙ্গুল o-র মত ঘুরিয়ে আঙ্গুলে-আঙ্গুলে একসঙ্গে লাগিয়ে বলল – “চুম্বক, ম্যাগনেট” !

যাদবপুরের ঘাস এই বন্ধু যাদবপুরে ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে বাধ্য হয়, কিন্তু মেজাজে সে ছিল পারির মঁমার্ত বা নিউ-ইয়র্কের গ্রীনউইচ ভিলেজের লোক। এই মৃত বন্ধুর কথা মনে হলে আমার মনে হয় আমার এক পরিচিতা মহিলার কথা যার মাথায় আজব আজব আইডিয়া ঘোরে, বিচিত্র বিষয়ে বিচরণ, অস্থির, স্পষ্টবাদী যাকে আমি বলি – “তোমার সত্তরের কালী-ফোর্ণিয়ায় জন্মানো উচিত ছিল, দুর্ভাগ্য আছো আজকের কালী-ঘাটে।” যাই হোক, যাদবপুরে সে ভর্তি হল, সেসময়, কি সেই সময় ? সেই মৃত প্রতিভা-ধনী কিন্তু আয়ু-দরিদ্র  বন্ধুর কথা ধার করে বলি – “ঘাসও সেসময় লাল ছিল।”আর আজকে :  Vanitas Onmi, Omni Vanitas.


পলাশবন্ধু

“পলাশবাণী কলকাতা” – পলাশ সেনের কলকাতা-দর্পণ – ৩

[ আমার বন্ধু ও জীবন-নির্দেশক পলাশ সেনের কলকাতা প্রেম আমার মধ্যে সংক্রামিত হয়েছিল। ইতালীর নেপলসে চিরতরে স্বেচ্ছা-নির্বাসনের আগে তার “কলকাতা নোট” তিনি আমাকে দিয়ে যান। সেই নোট আর ভ্রমণের ফল হল ইংরেজীতে লেখা কড়চা – Calcutta Culture Glossary তার ভাবশরীর অনুবাদ ]


“আমার মনে কোন গ্লানি নেই” : কলকাতায়এক অতি-অভিজাত  মহিলা “এসকর্ট”-র সঙ্গে আমার পরিচয় হয় তিনি যখন ছদ্মনামে লিখতে শুরু করেন আমাদের পত্রিকা (www.pentasect.com)। প্রায় দশ বছর আগের কথা।  একবার আমাদের পত্রিকার লেখক-সম্পাদক বৈঠকে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়। পরে একসময় এই মহিলা, ফরাসী “মাদামের” মতো আমায় বলেছিলেন, তার বাংলা আর ইংরেজী অতি উচ্চস্তরের ছিল, নিজের জীবিকা সম্পর্কে : “আমার মনে কোন গ্লানি নেই।”  তার কথায় অপূর্ব তেজ ছিল, ইনি তেজস্বিনী ছিলেন। “যা দেবী সর্বভূতেষু দীপ্তিরূপেন সংস্থিতা।”  আমি আমাদের অনেক গল্প লেখকদের তার এই তেজস্বীতার উপরে একটি গল্প লেখার অনুরোধ করেছি।

হরিবোল ক্লাব  : দমদম অন্চলে এই ক্লাব আছে। উদ্দেশ্য : দাহ-সংস্কারে সাহায্য। সংস্থার নেতা দাসদা একসময়ে সিআইডিতে চাকরী করতেন। চার্লস শোভরাজকে গোয়াতে যে টীম ধরেছিল, দাসদা এই টীমে ছিলেন। তার একটা মুদ্রাদোষ ছিল – কিছু হলেই বলতেন – “কেসটা কি ?” আমুদে লোক। খেতে-খাওয়াতে ভালবাসতেন। তিনি অজস্র অর্থ ব্যয় করে এই সংস্থা চালাতেন। আমায় একদিন বলেছিলেন, নিমতলার ঘাটে : “কেসটা হল আমরাই বুঝলে শেষ বন্ধু।” দাসদার মতো লোক আছেন বলে কলকাতা ছাড়া যায় না আর লিখতে ইচ্ছে হয়। ইনি আপনভোলা বাঙ্গালী, এই গুণ না থাকলে বাঙ্গালী বাঙ্গালী নয়, তা তুমি যত এলেমদার, রেস্তওয়ালা, ট্যাঁশফিরিঙ্গি চালাকই হও না বাপু। “কেসটা কি ?”

দফা ৩০২ : আমার অকালমৃত বন্ধু  কলকাতার ইউ-এস-আই-এস লাইব্রেরীতে নিয়ে যায়। রাশভারী মহিলা লাইব্রেরীয়ান। বন্ধুর প্রশ্ন : একটা বই খুঁজছি ? কি বই ? দফা ৩০২। পাওয়া যাবে ? লাইব্রেরীয়ানের মুখটি দেখার মতো ছিল।

“কুকুর নাই” : সল্টলেকের বাড়ীর সামনে লেখা। ভারী রসিক মালিক।

“মোদের শান্তিনিকেতন” : আমার এক বন্ধু একবার বোলপুরে গিয়ে মদ্যপান করে। সংস্কৃতিবান পিতার কাছে খবর পৌছায়। পিতা তাকে বকা দিলে সে বলে, আমি কি করব, ষ্টেশনেই ত লেখা ছিল – “মোদের শান্তিনিকেতন”।

ডক-জক দুই ভাই

[ আমার বন্ধু ও জীবন-নির্দেশক পলাশ সেনের কলকাতা প্রেম আমার মধ্যে সংক্রামিত হয়েছিল। ইতালীর নেপলসে চিরতরে স্বেচ্ছা-নির্বাসনের আগে তার “কলকাতা নোট” তিনি আমাকে দিয়ে যান। সেই নোট আর ভ্রমণের ফল হল ইংরেজীতে লেখা কড়চা – Calcutta Culture Glossary তার ভাবশরীর অনুবাদ। ছেলে-পুলেদের পড়াশোনা মধ্যবয়সী বাঙ্গালী পুরুষ-নারীর কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ, স্থান আর পাত্র / পাত্রী বিশেষে একমাত্র বিষয়। পলাশবন্ধুর সঙ্গে দুটি ছেলের পরিচয় ছিল – দুই ভাই কিন্তু ভিন্ন জীবনাদর্শের লোক। এই ছড়া হাল্কা চালে লেখা কিন্তু বিষয় গুরুতর, অতি গুরুতর – ছেলেমেয়ের পড়াশোনা। ]


ডক-জক দুই ভাই  

“কলিকাতা নগরে, সল্টলেক শহরে, দুই ভাই করে বাস।

ডক-জক নামধরী, ফন্দির শিরোমণি, করে শুধু ফিসফাস।

ডক করে গবেষণা, জক খায় চকলেট ;ডক কয় এইবার থালি হল বাবার পকেট।

ডক পড়ে মন দিয়ে, লেখাপড়ায় ভারী মন,

জক বলে  পড়াকু হয়ে দেখি নষ্ট করলি জীবন !

ডক বলে এইবেলা পড় কিছু, পরীক্ষা যে এলো কাছে,

জক বলে পরীক্ষার কাগজে জীবনের কি কথা আছে ?


ডক বলে ফেল হবি, এই বেলা পড়ে নে,

জক বলে – মার্কসের চাটনি খাব কি বানিয়ে ?

ডক পড়ে বই থেকে, ডক পড়ে অনলাইন,

জক শুয়ে তাকিয়ায়, ব্যস্ত তার ফোনলাইন।

ডক ঘাঁটে পুস্তক, ডক যায় কোচিং-এ,

জক দেয় আড্ডা -এপে আর জুমে-তে।

টিপস্ নেয় বন্ধুর, ঘুষ দেয় চকলেট,

বলে – কবিরাজি শিখছি, এই খা কাটলেট।

ডক বলে ফেল হলে লজ্জা, লোকে কি বলবে ?

জক বলে দুনিয়া ঠিকঠাকই চলবে।

শোন দাদা, ফেল হলে একটিই কষ্ট,

দুবার স্কুলে টাকা দাও, এই কথা স্পষ্ট। “

ডক ডক্টরের অপভ্রংশ

জক লাইফ জকি’র (Life Jockey) র অপভ্রংশ  

পলাশবন্ধু

“পলাশবাণী কলকাতা” – পলাশ সেনের কলকাতা-দর্পণ – ৫

[ আমার বন্ধু ও জীবন-নির্দেশক পলাশ সেনের কলকাতা প্রেম আমার মধ্যে সংক্রামিত হয়েছিল। ইতালীর নেপলসে চিরতরে স্বেচ্ছা-নির্বাসনের আগে তার “কলকাতা নোট” তিনি আমাকে দিয়ে যান। সেই নোট আর ভ্রমণের ফল হল ইংরেজীতে লেখা কড়চা – Calcutta Culture Glossary তার ভাবশরীর অনুবাদ।] 


সেনসেনালিষ্ট বাঙ্গালী ভদ্রলোক : একধরণের বাঙ্গালী আছেন, সাধারণতঃ আমুদে ও মজার, কিন্তু মানসিকভাবে সেনসেনালিষ্ট, অর্থাৎ আজব-অদ্ভুত বিষয়ে অতি-উৎসাহ। এই মানসিক প্রকৃতিকে হুজুগে পরিণত করাই একধরণের আন্ত্রপ্রনরের মূল কাজ। ভদ্রলোক আমাকে একদিন “সেনসেশনের” খবর দিতে লাগলেন। “দুনিয়া কত আশ্চর্য্যের, জানেন, আমি খবর পেয়েছি, শ্রীদেবীকে ডাউদ ইব্রাহিমের লোকেরা মেরেছে।” আমি বললাম – সে হতে পারে। “আরে, অমিতাভ বচ্চনের বাড়ীতে ঘোর ঝগড়া লেগেছে মশাই – বৌমা-ননদে, কেস জন্ডিস”, আমি বললাম – সে হতে পারে। তিনি আরো কি বলতে যাচ্ছিলেন, আমি বললাম – “আমি গান শুনব। অতি সাধারণ কথা – আটপৌরে, অজস্রবার বলা হয়েছে : “গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে / মৃদুল মধুর বংশী বাজে।” আপনি একবার ভাববেন যে এই বাঁশির কথায় এত জাদু কেন ? এত সাধারণ – বাঁশের টুকরো আর বাতাসের শ্বাস অথচ কেন মোজার্ট বলেন – zauberflöte, আমরা বলি জাদুবাঁশি বা বাঁশির জাদু।

মহিলা-কবি :  শব্দটি আপত্তিকর। মহিলা-কবির অর্থ অনেকটা স্ত্রী-আত্বা বা পুরুষ-আত্বা বলা। আত্বা লিঙ্গাতীত – আর আত্বার একটি অবস্থার নামই কবিতা। ক্যাডার-লীডার-কমরেড-ম্যানেজার স্ত্রী-পুরুষ হতে পারে, কিন্তু, কবি – শুধু কবি। সর্বোপাধি বিনির্মুক্তা।  অস্তিত্বের কথা নিয়ে যার কাজ-কারবার,  আর অস্তিত্ব ত লিঙ্গাতীত।


বাঙ্গালী বৃদ্ধের ফরাসিনী সচিব : স্বাস্থ্যবান, সচল আর জীবনরসে ভরপুর এক অভিজাত বাঙ্গালীর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। বয়স সত্তর। ধনবান যদিও সর্বহারাস্তোত্রের পাঠক ছিলেন। বিপত্নীক। একদিন কথায় কথায় আমি বললাম – আপনি ধনবান, সচ্ছল, রুচিবান পুরুষ – আপনি একটি যুবতী সচিব নিয়োগ করুন। তার কাজ হবে আপনার সঙ্গ দেওয়া, আপনার কাগজ-পত্র রাখা, সংক্ষেপে “প্রিয়াশিষ্যা, সচিব, কলাবধু”। আপনি সচিবের সঙ্গে গঙ্গার ঘাটে ঘুরে বেড়াবেন, দুপাত্র দুজনায় পানও করতে পারেন – সে আর্থিক সামর্থ্য আর সংযম আপনার আছে। “লোকে কি বলবে ?” আমি উত্তর দিলাম :প্রথম কথা, আমার প্রস্তাব ভারতবর্ষের আইনে সিদ্ধ। আর যদি আপনার অযোগ্য বাঙ্গালী  স্বজাতির মতামতের উপরে নির্বোধের মত মোহ থাকে, তবে আরেকটি পথ আছে। “আপনি এই বাড়ীটি (সল্টলেক ভিলার মালিক)  বিক্রি করুন। একটি সার্ভিসড্ এপার্টমেন্ট ভাড়া নিন। ফরাসীদেশে আমার চেনাশোনা আছে। মাসিক দুই লক্ষ টাকা মাহিনা আর থাকা-খাওয়া আলাদা একটি ফরাসিনী যুবতী, বয়স সাতাশ-আঠাশ, তপ্তকাঞ্চনগৌরাঙ্গী, মধুকন্ঠী – ইংরেজীতে দক্ষ, আপনার সচিব হইবে। ফ্রিল্যান্সার ও ফ্রি। আর এরপরে আপনি একটি বই লিখুন। শিরোনাম : পৌষ-বসন্ত। ফরাসীতে অনুবাদ মাদমোয়াজেল করিবেন। ভল্টেয়ারের উদাহরণ স্মরণ করুন। আপনার সে সামর্থ্য আছে।*
 পলাশবন্ধু

“পলাশবাণী কলকাতা” – পলাশ সেনের কলকাতা-দর্পণ – ৫

[ আমার বন্ধু ও জীবন-নির্দেশক পলাশ সেনের কলকাতা প্রেম আমার মধ্যে সংক্রামিত হয়েছিল। ইতালীর নেপলসে চিরতরে স্বেচ্ছা-নির্বাসনের আগে তার “কলকাতা নোট” তিনি আমাকে দিয়ে যান। সেই নোট আর ভ্রমণের ফল হল ইংরেজীতে লেখা কড়চা – Calcutta Culture Glossary তার ভাবশরীর অনুবাদ।] 


সেনসেনালিষ্ট বাঙ্গালী ভদ্রলোক : একধরণের বাঙ্গালী আছেন, সাধারণতঃ আমুদে ও মজার, কিন্তু মানসিকভাবে সেনসেনালিষ্ট, অর্থাৎ আজব-অদ্ভুত বিষয়ে অতি-উৎসাহ। এই মানসিক প্রকৃতিকে হুজুগে পরিণত করাই একধরণের আন্ত্রপ্রনরের মূল কাজ। ভদ্রলোক আমাকে একদিন “সেনসেশনের” খবর দিতে লাগলেন। “দুনিয়া কত আশ্চর্য্যের, জানেন, আমি খবর পেয়েছি, শ্রীদেবীকে ডাউদ ইব্রাহিমের লোকেরা মেরেছে।” আমি বললাম – সে হতে পারে। “আরে, অমিতাভ বচ্চনের বাড়ীতে ঘোর ঝগড়া লেগেছে মশাই – বৌমা-ননদে, কেস জন্ডিস”, আমি বললাম – সে হতে পারে। তিনি আরো কি বলতে যাচ্ছিলেন, আমি বললাম – “আমি গান শুনব। অতি সাধারণ কথা – আটপৌরে, অজস্রবার বলা হয়েছে : “গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে / মৃদুল মধুর বংশী বাজে।” আপনি একবার ভাববেন যে এই বাঁশির কথায় এত জাদু কেন ? এত সাধারণ – বাঁশের টুকরো আর বাতাসের শ্বাস অথচ কেন মোজার্ট বলেন – zauberflöte, আমরা বলি জাদুবাঁশি বা বাঁশির জাদু।

মহিলা-কবি :  শব্দটি আপত্তিকর। মহিলা-কবির অর্থ অনেকটা স্ত্রী-আত্বা বা পুরুষ-আত্বা বলা। আত্বা লিঙ্গাতীত – আর আত্বার একটি অবস্থার নামই কবিতা। ক্যাডার-লীডার-কমরেড-ম্যানেজার স্ত্রী-পুরুষ হতে পারে, কিন্তু, কবি – শুধু কবি। সর্বোপাধি বিনির্মুক্তা।  অস্তিত্বের কথা নিয়ে যার কাজ-কারবার,  আর অস্তিত্ব ত লিঙ্গাতীত।


বাঙ্গালী বৃদ্ধের ফরাসিনী সচিব : স্বাস্থ্যবান, সচল আর জীবনরসে ভরপুর এক অভিজাত বাঙ্গালীর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। বয়স সত্তর। ধনবান যদিও সর্বহারাস্তোত্রের পাঠক ছিলেন। বিপত্নীক। একদিন কথায় কথায় আমি বললাম – আপনি ধনবান, সচ্ছল, রুচিবান পুরুষ – আপনি একটি যুবতী সচিব নিয়োগ করুন। তার কাজ হবে আপনার সঙ্গ দেওয়া, আপনার কাগজ-পত্র রাখা, সংক্ষেপে “প্রিয়াশিষ্যা, সচিব, কলাবধু”। আপনি সচিবের সঙ্গে গঙ্গার ঘাটে ঘুরে বেড়াবেন, দুপাত্র দুজনায় পানও করতে পারেন – সে আর্থিক সামর্থ্য আর সংযম আপনার আছে। “লোকে কি বলবে ?” আমি উত্তর দিলাম :প্রথম কথা, আমার প্রস্তাব ভারতবর্ষের আইনে সিদ্ধ। আর যদি আপনার অযোগ্য বাঙ্গালী  স্বজাতির মতামতের উপরে নির্বোধের মত মোহ থাকে, তবে আরেকটি পথ আছে। “আপনি এই বাড়ীটি (সল্টলেক ভিলার মালিক)  বিক্রি করুন। একটি সার্ভিসড্ এপার্টমেন্ট ভাড়া নিন। ফরাসীদেশে আমার চেনাশোনা আছে। মাসিক দুই লক্ষ টাকা মাহিনা আর থাকা-খাওয়া আলাদা একটি ফরাসিনী যুবতী, বয়স সাতাশ-আঠাশ, তপ্তকাঞ্চনগৌরাঙ্গী, মধুকন্ঠী – ইংরেজীতে দক্ষ, আপনার সচিব হইবে। ফ্রিল্যান্সার ও ফ্রি। আর এরপরে আপনি একটি বই লিখুন। শিরোনাম : পৌষ-বসন্ত। ফরাসীতে অনুবাদ মাদমোয়াজেল করিবেন। ভল্টেয়ারের উদাহরণ স্মরণ করুন। আপনার সে সামর্থ্য আছে।*


 পলাশবন্ধু

“পলাশবাণী কলকাতা” – পলাশ সেনের কলকাতা-দর্পণ – ৬

[ আমার বন্ধু ও জীবন-নির্দেশক পলাশ সেনের কলকাতা প্রেম আমার মধ্যে সংক্রামিত হয়েছিল। ইতালীর নেপলসে চিরতরে স্বেচ্ছা-নির্বাসনের আগে তার “কলকাতা নোট” তিনি আমাকে দিয়ে যান। আর আমাদের ফ্রিল্যান্স সঙ্ঘকে তার ফ্ল্যাটটি দান করেন। সেই নোট আর ভ্রমণের ফল হল ইংরেজীতে লেখা কড়চা – Calcutta Culture Glossary তার ভাবশরীর অনুবাদ।] 


সেনসেক্স : এখন সেনসেক্স খুব বাড়ছে। পলাশ সেনের সেক্স-কে তাহলে বলা যেতে পারে – সেনসেক্স। আর শচীন সেন যদি পাগল হয়ে যান তাহলে আমরা বলতে পারি Such Insane. প্রথমটির স্রষ্টা আমার বন্ধু ফ্ল্যাটপেঁচার বন্ধু মণি ফকির আর দ্বিতীয়টির স্রষ্টা শিব্রাম চক্রবর্তী।

শ্রীমতি নবনীতা দেব সেন :  যে বাঙ্গালী কবি-লেখিকা কিছুদিন আগে অমরলোকে গত, তার সঙ্গে আমার একবার দেখা করার খুব ইচ্ছে ছিল। সে হয়ে ওঠেনি। আমার একটি ভাগ্নী আছে – বয়স সতেরো, তার চিন্তা-ভাবনা আলাদা – ঠিক বঙ্গীয় নয় আর তাই বঙ্গীয় মাতা-পিতা চিন্তিত। সে বাংলা-টাংলা বিশেষ পড়ে না – তার “বোরিং” লাগে। আমি একদিন ভাবলাম এদের মাতা-পিতার উপদেশে কাজ হবে না। উচ্চতম গোত্রের “এন্টি-ট্যাশফিরিঙ্গি” ওষুধ দিতে হবে। এই ওষুধের নাম শ্রীমতি দেবসেন।  প্রথমে তাকে শ্রীমতি দেবসেনের ছবি দেখালাম – কপালে বিশাল ফোঁটা। ভাগ্নী ভাবলো – এ আবার কি ? এই গিন্নি-বান্নি মাসীমা জাতীয় মহিলা আবার কে ? এবার ডান্ডা : “ইনি কেম্রিজে আর বার্কলের ছাত্রী – আজকের যুগের কেম্রিজ আর বার্কলে নয়। ইনি মিশনারী স্কুলে পড়েছেন আর বাড়ীতে বাংলা শিখেছেন। এনার স্বামী যার সঙ্গে পরে ছাড়াছাড়ি হয় তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন আর সে শুনে ইনি লিখেছেন, নিজেকে নিয়ে ঠাট্টা করে – “পোড়াকপালি, সুথ ধরে রাখতে পারলি না” – বার্কলের পি-এইচ-ডি আর যাদবপুরে বুদ্ধদেব বসুর ছাত্রী। বাড়ীতে গেলে তাকে দেখে মনে হবে পাকা গিন্নির মতো – কে বলবে ইনি মহাশক্তিমান, মহামেধাবী, মহাবিদুষী কবি আর স্রষ্টা ? কিন্ত, সবাইকে খাইয়ে দাইয়ে, তিনি যখন ডেস্কে – কলম হাতে, জগৎ বিস্মৃত – যাদবপুর-কেম্রিজ-বার্কলে-খ্যাতি-প্রতিভা-প্রতিষ্ঠা অতিক্রম করে ইনি বাংলা ভাষায় সৃষ্টিকার্যে রত। গভীর বিনয়ের সঙ্গে বাংলা ভাষায় লিখছেন, ছোটদের জন্য লিখেছেন, সারা জগৎ তার আত্বীয়, অজস্র ঐশ্বর্য্য অর্জন ও অতিক্রম করে  – সরীর-এ-খমা, নওয়া এ সরোষ হ্যায় ! আমি মনে করি ইনি বাংলার সীমন দ্য বোভোয়া কিন্তু পুরোপুরি বাঙ্গালী আর ইনি বাংলার খুব কম সাহিত্যিকদের মধ্যে একজন খ্যাতি যাকে নষ্ট করতে পারে নি।


যাদবপুরের বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক : এক অধ্যাপক, বাঙ্গালী, প্রগতিশীল, সরকারী মাহিনা-পুষ্ট নিরাপদ সুরক্ষিত জীবন, আলাপে বলেছিলাম আমি পাড়া- গাঁর লোক, কলিকাতায় নতুন আসিয়াছি। ব্যাস, অধাপক বেশ জুৎ করে আমাকে অনেক কিছু বোঝালেন, দেরিদা, ফুঁকো, হিদেগার – ইনি সবই পড়েছেন অনুবাদে – তার একবারো মনে হল না জীবন কি এতই সহজ ? সেও মানা গেল, কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে তিনি একটি আপত্তিকর মন্তব্য করলেন। এইবার আমার আর সহ্য হল না। আপনার তার মতবাদের সঙ্গে একমত না হওয়ার অধিকার আছে, থাকতেই পারে, কিন্ত তার মহত্বের প্রতি আপনার শ্রদ্ধা খাকতেই হবে। আপনি যা বললেন, তা প্রাচীন বঙ্গীয় চন্ডীমন্ডপের “খেউড়” – এত দেরিদা, ফুঁকো, হিদেগার সেই ভূতকে তাড়াতে পারেন নি  ! কেন ? কারন আপনি আছেন শর্ট-কার্টে – আপনাকে যদি এদের মূলে পড়ার জন্য ফরাসী আর জার্মান শিখতেন (প্রাচীন বাঙ্গালী তাই করত) – তবে সেই সাধনা আর সংগ্রামের ফলেই আপনি বুঝতে পারতেন “সাধনা” আর বাতেলার তফাৎ আছে। আপনি তখন সত্যি সত্যি মহৎ জীবনের কথা একটু ভালো করে বুঝতে পারবেন আর সংযমী হবেন।

কলকাতা মেট্রো: কলকাতার পাতালরেলের নাম “আন্ডারগ্রাউন্ড” না হয়ে লোকমুখে মেট্রো কেন হল এই রহস্যের সমাধান আমি আজো করতে পারি নি। এটি কি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতার জন্য না ফরাসী প্রেমের জন্য না মেট্রো সিনেমার জন্য ? আমি জানি না। তবে যখন মেট্রো প্রথম চালু হয়, আমি দশ বছরের বালক – প্রথমবার মেট্রো চড়ে আমার মনে হল – পাতাল স্বর্গ ! এখনও মেট্রোতে উঠলেই আমার সেই প্রথম স্পর্শের কথা মনে হয়। 

পলাশবন্ধু

“পলাশবাণী কলকাতা” – সেলুনওয়ালার চারটি এক ঢোঁকের গল্প

[ আমার বন্ধু ও জীবন-নির্দেশক পলাশ সেনের কলকাতা প্রেম আমার মধ্যে সংক্রামিত হয়েছিল। ইতালীর নেপলসে চিরতরে স্বেচ্ছা-নির্বাসনের আগে তার “কলকাতা নোট” তিনি আমাকে দিয়ে যান। আর আমাদের ফ্রিল্যান্স সঙ্ঘকে তার ফ্ল্যাটটি দান করেন। সেই নোট আর ভ্রমণের ফল হল ইংরেজীতে লেখা কড়চা – Calcutta Culture Glossary তার ভাবশরীর অনুবাদ।] 

সেলু্নওয়ালার চারটি গল্প: কলকাতার সেলুনওয়ালাদের ধরলে সেই পাড়ার সব খবর পাওয়া যায়। কলকাতার আসল সামাজিক ইতিহাসের খবর অধ্যাপক-গবেষকদের কাছ থেকে বেশী আছে এদের কাছে। আমি অন্তত তাই মনে করি :”হেয়ার-কল্বিন-পামর-কেরী-মার্শম্যান” যখন প্রথম হুগলীর পারে এলেন তাদের সঙ্গে দৈনন্দিন মোলাকাত অধ্যাপক-বুদ্বিজীবী-ক্যাডার-ক্লার্কদের হয়নি – হয়েছিল এই সেলুনওয়ালাদের মত লোকের। ভারত সাম্রাজ্যের ভিত্তিভূমি, রাজধানী কলকাতায় এই শ্রেণী ছিলেন সাম্রাজ্যের স্থপতিদের “প্রথম পার্টনার”। কলকাতার এক পন্ডিত লিখেছিলেন : “হেয়ার-কল্বিন-পামর-কেরী-মার্শম্যাস্থতা / পঞ্চগোরা স্মরেনিত্যং মহাপাতকনাশনম্” । এই সেলুনওয়ালার চারটি গল্প। একে আমি আদর করে ডাকতাম – এজেন্ট মোহন।


মহাপ্রাণ কিন্ত নির্বোধ মানসিক সাম্যবাদী  :  পূর্ব কলকাতার এক প্রান্তিকায়িত অঞ্চলে নব্বই দশকের শেষে “প্রমোটারি” শুরু হয়। একটি আবাসনের ফ্ল্যাটে এক শিক্ষিত, মহাপ্রাণ, উদার কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে নির্বোধ এক ভদ্রলোক তার পরিবার সহ বাস করতে আসেন। তার দুই ছেলে ক্লাস এইটে আর টেনে পড়ে। প্রতিবেশী ছেলে-দের সঙ্গে তার ছেলেদের মেলামেশা শুরু হয়। তার মহাপ্রাণ মনে মনে হয়েছিল যে তার সাহচর্যে এদের মানসিক উন্নতি হবে। উদার আর মহৎ লোকের স্বভাব এই যে সে অন্যদরেও তার মতই মানসিক গঠনের মনে করে। কিন্তু উল্টো হল। তার দুই ছেলে বছর দুয়েকের মধ্যেই “প্রতিবেশী বন্ধু” সান্নিধ্যে বখে গেল – কচি বাঘকে সোনার-গাজির রক্তের স্বাদের নেশা ধরালো বন্ধুরা। অবশেষে পিতার মৃত্যু, ভগ্নস্বাস্থ্য, ঋণডুবি হয়ে দুই ভাই ফ্ল্যআট বিক্রি করে চলে গেল কোন পাড়া-গাঁয়ে। “বন্ধুরা” অনেকেই প্রোমোটারি, দালালি করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। পরিবারটির কাছে প্রবলভাবে ঋণী হয়েও ভাই দুটির চরম দুঃসময়ে সবাই এড়িয়ে গেল। সেলুনওয়ালার উপসংহার : “দো ভাই নেস্তনাবুদ হো গিয়া।”


প্রমোটারি ষ্টেরয়েড :  যখন কোন পরিবার, জনপদ বা দেশের আর্থিক, মানসিক, বৌদ্ধিক, সাংস্কৃতিক, যাবতীয় সম্পদ আর থাকে না, তখন তিনটি ভগবৎ প্রদত্ত জিনিষ বাকী থাকে আর শুধু তারই বিক্রি শুরু হয় – সস্তার মেহনত, জমি, জোরু। অনেক পরিবার প্রোমোটারি ষ্টেরয়েড নেয় – ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। এই ষ্টেরয়েড হল, জমি বিক্রির কবালা আর আগামী দশ বছরের রোজগার কয়েক মাসেই একসঙ্গে ক্যাশে প্রাপ্তি। অনেকেই এরপরে “জীবনের বন্দোবস্ত” হয়ে গেছে ভেবে বাবুয়ানায় লেগে যান। বাবুয়ানার মূল চরিত্রলক্ষণ হল – কর্মনাশা বিচিত্র শখ আর আলস্য। আর বাইরের লোকেরা বাহবা দেয় – “আরে… আপনার আর চিন্তা কি! আরামে আছেন মশায়।” পাঁচ বছরেই যে প্রক্রিয়ায় “প্রমোটারি স্টেরয়েডের” উদ্ভব, তারই ফলে মন্দা আর সুদের হার কমা, অর্থাৎ এম-আই-এস কম আর ভয় ! এই ভয়ের কারন – “আরাম হারাম হ্যায়।” আড়াইশো বছর আগে পশ্চিম ইউরোপের যুবকেরা বেঘোরে মরছে সমুদ্রপার করতে গিয়ে, ম্যালেরিয়ায় আর বঙ্গীয় চন্ডীমন্ডপে আলোচনা – “চাটুয্যেদের বৌটি সন্ধ্যায় ঘাটে চান করতে কেন যায়?” আরাম হারাম হ্যায়।

সুরা ঔর সুন্দরী :  সে সময় কলসেন্টারের স্বর্ণযুগ। একদিন রাত আটটা হবে, আমি সেলুনে দাড়ি কামচ্ছি, দেখি সামনের রাস্তায় একটি সুন্দরী মেয়ে, বছর বাইশ, কোম্পানীর গাড়ী থেকে নামছে। পটলচেরা চোখ, ছিপছিপে গড়ন, সুরাসিক্ত দৃষ্টি আর সুরায় অভ্যস্ত। সেলুনওয়ালার দৃষ্টি আকর্ষণ করায় বাইরে এক ঝলক থাকাল, হাতে ক্ষুর – “বাহ ! কটিলৈ নিগাহে ! আহা, আহা ! সাব, ইসকো বলতে হে – সুরা ঔর সুন্দরী।

লিভ-ইন: সেই সময়ের কথা যখন “লিভ-ইন” ভারতবর্ষে প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে আইনসিদ্ধ হল। সেলুনওয়ালার পাড়া আর আমারো পাড়া ছিল সেকটর ফাইভের কমবয়সী ছেলেমেয়েতে ভর্তি। সেই সময়ে আমাকে সে খোসগল্প করতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে যে এই লিভ-ইন বিষয়ে আমার কি মত। আমি বললাম যে আমি দুখী কারন আমার একুশ বছর বয়সে লিভ-ইন বে-আইনী ছিল। সে খুব খুশী হয়ে বলল যে তারো এই দুঃখ আছে। তারপরে সে আনমনা হয়ে বলল যে – লেকিন, এক বাত হ্যায়, এরকম হতে পারে যে কেউ কোনদিন লিভ-ইন করেনি, কিন্তু যে একবার করেছে সে একবারে থেমে থাকতে পারবে না। আপনার কি মনে হয় ? আমি তখন ভাবছিলাম আমার অন্যতম প্রিয় দর্শন লেখক ফরাসী লেখক রশেফুঁকোর মন্তব্য, তিনশো বছর আগের প্যারিসে : It is quite possible to find a woman who has not a single love affair but it is impossible to find a woman who has only one.


বিগ-ব্যাং সে ভি-আই-পি রোড: একদিন সেলুনে গেছি – লোক নেই। বৃষ্টি পড়ছে। সেলুনওয়ালা চা-সিগারেটে আপ্যায়ণ করল। বলল তার কাছে “পালংতোড় পান” আছে, আমি বললাম আমি ত পান খাই না আর পালং-এ শুই না। তার এক সহকর্মী ছিল – সে গাঁজা খেত। সে বলে – সাব, আমি স্বপ্ন দেখেছি যে এই সব চিকেন যাদের মেরে আমরা খাচ্ছি তারা সবাই এসে আমাকে মারছে। এই সব কথা-বার্তা থেকে পূর্বজন্ম, পরজন্ম, স্বর্গ-নরক কথা এল। সে টিভিতে বিগ ব্যাং শুনেছে। তখন কেষ্টপুর-বাগুউহাটি মোড় জ্যাম আর ভিড়ের জন্য জগৎপ্রসিদ্ধ ছিল। কিপলিং সাহেব বেঁচে থাকলে এই দেখে লিখতেন – where vehicles and pedestrians cannibalize on each other. সেলুনওয়ালা এসব শুনে টুনে বললে – কিছু বাইকওয়ালা ছোকরার বাইক চালানো দেথে মনে হয় এরা বিড়-ব্যাং থেকে সরাসরি ভি-আই-পি রোডে এসে পৌছেছে – মাঝখানে কিছু্ই নেই। আমি মনে মনে চমৎকৃত হলাম – ব্যাটা বলে সাংঘাতিক !

পলাশবন্ধু

“পলাশবাণী কলকাতা” – “রাবিন্দ্রীক রবীন্দ্রসঙ্গীত” ও সমকালীন জীবনসঙ্গীত

[ আমার বন্ধু ও জীবন-নির্দেশক পলাশ সেনের কলকাতা প্রেম আমার মধ্যে সংক্রামিত হয়েছিল। ইতালীর নেপলসে চিরতরে স্বেচ্ছা-নির্বাসনের আগে তার “কলকাতা নোট” তিনি আমাকে দিয়ে যান। আর আমাদের ফ্রিল্যান্স সঙ্ঘকে তার ফ্ল্যাটটি দান করেন। সেই নোট আর ভ্রমণের ফল হল ইংরেজীতে লেখা কড়চা – Calcutta Culture Glossary তার ভাবশরীর অনুবাদ।] 

ব্রাহ্ম শুচিবায়ুগ্রস্ততা : শুচিতা আর শুচিবায়ুগ্রস্ততার মধ্যে তফাৎ আছে – এই বিষয় তারা আরো ভালোভাবে জানেন যাদের বাড়ীতে এরকম কেউ আছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত বিষয়ে এই কথা বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে। আমাদের বালককালে আর এখনকার বালকদের মনেও রবীন্দ্রসঙ্গীত বললে ভেসে ওঠে – ধূপ-ধুনো, পাট করা তাঁতের শাড়ী, “এথনিক” দুল আর গয়না, অতি-শিষ্ট ভদ্র সাদা পাঞ্জাবি পরা গায়ক – শ্রোতারাও অতি ভদ্র, সুশীল আর “স্যানিটাইজড্”। পৃথিবীতে কোন বিষয়কে যদি জীবন থেকে সরিয়ে নিতে হয় আর একটি “পান্ডাদের” কুক্ষিগত করতে হয়, তবে সবচেয়ে ভালো হচ্ছে শুচিবায়ুর বেড়া দেওয়া। জীবন চির-বহমান। আমাদের শরীরের ভেতরে ত মল-মূত্র আছে, তাই বলে কি লোকে চুমু খায় না ?


প্রটোপ্লাজম আর “ইজম” : জীববিজ্ঞানীরা বলেন যে আমাদের দেহের কোষের মধ্যে আজব জিনিষ আছে – প্রটোপ্লাজম, ল্যাটিন প্রটো শব্দটি প্রণিধানযোগ্য । আর মানুষ অনেক “ইজম” বানিয়েছে – আবহমান কাল ধরে। “রাবীন্দ্রিক” একটি “ইজম” ঠিক যেরকম “মার্কসিজম”। এই “রাবীন্দ্রিক ইজম”-এ দুই শ্রেণী আছে – যাদের এই ইজমের সঙ্গে বৈষয়িক বা ব্যবসায়িক যোগ আছে (যারা অনেক লাভজনক প্রতিষ্ঠান চালান) আর যাদের কোন বৈষয়িক বা ব্যবসায়িক যোগ নেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রটোপ্লাজম কোন ইজমের কথাই শুনতে বাধ্য নয়। তাই অজস্র “রাবীন্দ্রিক-ইজম”-ওয়ালাদের চেষ্টা-অপচেষ্টা সত্ত্বেও শতবর্ষে পরেও অশুচি, অর্বাচীন, “বর্বর” কমবয়সীরা নিভৃত মুহুর্তে, সুরাসিক্ত অবস্থায় গাইছে তার গান – খালি গান, গুরুদেব নন, মহাকবি নন, বাংলার শ্রেষ্ঠতম ঐশ্বর্য্যময় পুরুষ আর  অগণ্য রমণীসেবিত পুরুষ – সব উপাধি ছেড়ে, স্বরলিপির বানান না জেনে, বাংলা না পড়তে পেরে…. “মায়াবন বিহারিণী হরিণী, গহন স্বপন সঞ্চারিণী”…


গেল গেল রব: “মায়াবন বিহারিণী হরিণী, গহন স্বপন সঞ্চারিণী” গেয়ে এক গায়িকার কপালে অনেক লাঞ্ছনা জুটেছে বলে জানিয়েছেন এই বিষয়ে খোঁজখবর রাখনেওয়ালা শ্রীমান অলাবু। তার অনুরোধে একবার গেলাম সেই গায়িকার গান শুনতে। গিয়ে দেখি, আরে প্রটোপ্লাজমের জয় ! জিনস-পরিহিতা (টানটান তাঁতের শাড়ী নয়), খোলা ষ্ট্রেট চুল (ভিনটেজ ছবির খোঁপা নয়), কানে ছোট হীরের দুল (মাকড়ি নয়), দাঁড়িয়ে সোজা হয়ে (বসে অতি আয়োজনে আশ্রমিক প্রকরণে নয়), ধূপ-ধুনোর গন্ধ নয় (সামনের শ্রোতা ছোকরা-ছোকরীদের মুখে Budweiser গন্ধ) । গায়িকা ধানাই-পানাই, কেরামতি, মন্দাক্রান্তা ছন্দের আলাপ না করে সোজা বললেন – “এই গান বিতর্কিত হয়েছে। কিন্তু আমার এই গান খুব প্রিয়। তাই গাইছি।” কিসের বিতর্ক ? আমি জানি না। ধরে নেওয়া যাক, “মায়াবন বিহারিণী হরিণী, গহন স্বপন সঞ্চারিণী” লেসবিয়ান থীমের উদ্দেশ্য গাওয়া ? তাতে কি ? গানের কি লিঙ্গ হয় ?

যারা এই “গেল গেল রব করছেন”, খবর নিয়ে দেখা যাবে, এদের বেশীরভাগই প্রটোপ্লাজমের পজ (pause) স্তরে – শারীরিক ও মানসিক দুভাবেই। যাই হোক, আমি খুশী হলাম। যে কবি সারাজীবন বঙ্গীয় মূঢ়ত্বের বিরুদ্ধে  সংগ্রামে আপসহীন আর যৌবনের গান জয়-জয়ন্তী রাগে গেয়েছেন, তার গান মানবহ্রদয়ের আর বিবর্তনের কোন তার ত স্পর্শ করতে পেরেছ। তবে সমসাময়িক বঙ্গীয় মূঢ়ত্বে তিনি অবাক হতেন না – আমি নিজের চোখে অক্সফোর্ডের বদলিয়েন লাইব্রেরীতে পুরোনো বাংলা পত্রিকায় দেখেছি এক তৎকালীন বাঙ্গালীর সমালোচনা – “রবি ঠাকুর ন্যাংটো মেয়েমানুষ দেখাবার জন্য এরকম লিখেছে।” (“পলাশবন্ধু ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ”, ওয়ার্ডস্মিথ ইউনিভার্সিটি প্রেস)
Shakespeare – Our Contemporaryরবীন্দ্রনাথ আর শেক্ষপীর (প্রথম ইংরেজী পড়িয়ে বাঙ্গালী শেক্সপীয়রকে এই নাম দিয়েছিলেন) দুজনেই আমাদের সমসাময়িক। হ্যামলেটের কতরূপ আমরা দেখেছি – সমকামীও। তাহলে “মায়া”-র প্রতি এত রাগ কেন ? ইংরেজ জাতি ত হ্যামলেট নিয়ে “গেল গেল” রব তোলে না। ভয়ে ভয়ে একটি কথা – ইংরেজ জাতি জাত হিসেবে শেক্সপীয়রকে গর্ভে ধারণ করার যোগ্য ছিল। আমরা বাঙ্গালীরা কি জাত হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে গর্ভে ধারণ করার যোগ্য ছিলাম বা আছি ?

 পলাশবন্ধু

“পলাশবাণী কলকাতা” – অর্থচিন্তা – একাউন্টিং-বুদ্ধি, ফাইনান্স-বুদ্ধি আর লাগ-ভেল্কি-লাগ বুদ্ধি

 [ আমার বন্ধু ও জীবন-নির্দেশক পলাশ সেনের কলকাতা প্রেম আমার মধ্যে সংক্রামিত হয়েছিল। ইতালীর নেপলসে চিরতরে স্বেচ্ছা-নির্বাসনের আগে তার “কলকাতা নোট” তিনি আমাকে দিয়ে যান। আর আমাদের ফ্রিল্যান্স সঙ্ঘকে তার ফ্ল্যাটটি দান করেন। সেই নোট আর ভ্রমণের ফল হল ইংরেজীতে লেখা কড়চা – Calcutta Culture Glossary তার ভাবশরীর অনুবাদ।] 

একাউনন্টিং বুদ্ধি  :  বঙ্গদেশের সাধারাণত অর্থ বিষয়ে তিন ধরনের বুদ্ধি দেখা যায়। একাউন্টিং-বুদ্ধি, ফাইনান্স-বুদ্ধি আর লাগ-ভেল্কি-লাগ বুদ্ধি। প্রথমটি অগণ্য, দ্বিতীয়টি খুবই বিরল আর তৃতীয়টি একটি চক্রে চলে। একাউন্টিং বুদ্ধির পরীক্ষা : এই ধরনের লোককে  (শিক্ষা-পেশা নিরপেক্ষ) একটি ট্রাক-ভর্তি ক্ষীরা আর চিনির দানার মতো হীরে দেওয়া হল। এই ধরণের বু্দ্ধি ট্রাকভর্তি ক্ষীরা পছন্দ করবে। কারন – প্রথমটি স্থূল, সামনে, হাল্লা হচ্ছে, বেশ জমজমাটি ব্যাপার। চিনির দানার মতো হীরে দেখাই যায় না আর তারপরে জহুরী খুঁজতে হবে। সংক্ষেপে – এই বুদ্ধি স্থূল। আর এই বুদ্ধির নিজের সম্পর্কে খুব উচ্চ ধারনা – “আরে বাবা, আমি সব বুঝি, ট্যাকের থেকে মাল সরিয়ে নেবে ভোগা দিয়ে… আরে আমি সে শর্মা নই।” একাউন্টিং বুদ্ধি পাটীগণিতের জগতে বন্দী- সময় / পরিবর্তন বা ক্যালকুলাস নেই। তাই এই বুদ্ধি দিয়ে যদি ব্যবসা নিয়ন্ত্রিত হয়, তবে মহাকাল ভরসা। আর এই কারনে পৃথিবীর অনেক বৃহৎ ব্যবসা অবলুপ্ত আর অনেক ধনবান পরিবার নির্ধন।


ফাইনান্স বুদ্ধি :  এরা বিরল – বঙ্গদেশে আরো বিরল আর উচ্চকোটির প্রায় একটিও নাই। প্রমাণ ইতিহাস। ফাইনান্স বুদ্ধি অতি-সূক্ষ, উচ্চকোটিতে অতি-সূক্ষ আর সর্বগামী। ইহুদীজাতিতে এই বুদ্ধির উৎতর্ষতা আর ইংরেজ আর আমেরিকানদের এই শ্রেণীকে বলে – “religion of Finance” ঠিক যেরকম উচ্চকোটির ইতালীয়ান মাফিয়াতে প্রবেশ  -কোসা নোষ্ট্রাকে আমেরিকান ইংরেজীতে বলে – “to enter Life (wiseguy / mob-life)” এই বুদ্ধি অর্থকে সূক্ষ, এ্কটি আইডিয়ার মতো দেখে, নৈর্ব্যক্তিক আর তার সন্ধানের বিষয় হচ্ছে – মুদ্রাস্ফীতি, কর, বিদেশী মুদ্রার সঙ্গে বিনিময়, আবিষ্কার, ভবিষ্যতের একা্‌উন্টিং, মনস্তত্ব, মগজ-ধোলাই – আজকের ও ভবিষ্যতের, মগজ-ধোলাইর যন্তর-মন্তর ( হার্ডওয়্যার-সফটওয়্যার – সমগ্র আইটি প্রযুক্তি), রাজনীতি, উচ্চতম স্তরের ব্যক্তিকে সাধু ও অ-সাধু উপায়ে নিয়ন্ত্রণের কলা-কৌশল, এথিকস্। বঙ্গদেশের দুর্ভাগ্য, বাংলার বুদ্ধিজীবিরা কার্ল মার্কসের ভক্ত অথচ ইনি ইহুদী বংশোদ্ভুত আর ফাইনান্স বুদ্ধির উচ্চতম কেটির একজন -কিন্তু এই বিষয়ে বাংলায় কোন আলোচনা নাই।

লাগ ভেল্কি লাগ বুদ্ধি :এই বুদ্ধির চক্রাকার উত্থান-পতন হয়।এই বুদ্ধি যে বঙ্গদেশে বা কোন দেশেই বিরল নয়, তার প্রমাণ অসাধু-চিটফান্ড বা যাবতীয় পনজি স্কীম। এই বুদ্ধির লোকেরা সর্বস্বান্ত হতে পারে ও হয়ও। এই বুদ্ধির দুটি খুঁটি – “অঘটন আজো ঘটে” আর “আরে, অমুক মহান লোক এর পেছনে আছেন।” এই বুদ্ধি পাল্টানোর কোন চিকিৎসা নেই আর তাই চক্রাকারে এই বুদ্ধির উত্থান-পতন দেখা যায়।

পলাশবন্ধু