[ আমার বন্ধু ও জীবন-নির্দেশক পলাশ সেনের কলকাতা প্রেম আমার মধ্যে সংক্রামিত হয়েছিল। ইতালীর নেপলসে চিরতরে স্বেচ্ছা-নির্বাসনের আগে তার “কলকাতা নোট” তিনি আমাকে দিয়ে যান। সেই নোট আর ভ্রমণের ফল হল ইংরেজীতে লেখা কড়চা – Calcutta Culture Glossary। পলাশ সেন পয়ত্রিশ বছর বয়সেই প্রথম যৌবনের মিতাচার, বন্ধু-প্রীতির দৌলতে তার জীবিকার সমস্যার সমাধান করেন। নববই দশকের শেষের দিকে তিনি আজকের কয়েকটি জগদ্বিখ্যাত আই-টি কোম্পানীতে নিউ-ইয়র্কের এক বন্ধুর মাধ্যমে টাকা লাগান। নিউ-ইয়র্কের ডলার, কলকাতার অবসরস্নিগ্ধ বুদ্ধি। তার বন্ধুটিও লাভবান হন। সরকারী চাকুরী ত্যাগ ও মুক্তপুরুষ পদবী লাভ। স্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবী ততদিনে পলাশ সেনের মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে দাম্পত্য কলহের শেকড় নাশ করেন। পরবর্তী দশ বছর তিনি কলকাতার “নিবাসী-দর্শক-সাক্ষী-ভোক্তা” হিসেবে কাটান। সেই সময় তার সঙ্গে আমার পরিচয় আর নিবিড় বন্ধুত্ব। ]
টালিগঞ্জে বিড়ম্বনা : একদিন সকালে এক বাসে চেপে বসলুম, কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই। পাশে বাঁদিকে এক মহিলা, তার চেহারা ভালো মনে নেই কিন্তু গলার স্বর মনে করে এখনো চাঞ্চল্য হয়। পশ্চিমবঙ্গীয় স্বর, “ল” আর “ট” তে পূর্ববঙ্গীয় প্রবল শ্বাসাঘাত নেই। অনুপ্রাস বর্ণগুলি যেন আদর পাচ্ছে। ইনি ফোনে কথা বলছেন। সংক্ষেপে শ্রীমতি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের “মধু মালতী ডাকে আয়”-তে যে কুহকের ডাক আছে, সে রকম। বাস পেরিয়ে গেল বেকবাগান, বালিগঞ্জ, যাদবপুর – হঠাৎ মহিলা নামলেন। আমি যন্ত্রের মতো নামলাম। কোন এক গলিতে সম্মোহিতের মতো তার পেছনে – হঠাৎ সে ঘুরল – “আপনি কি আমাকে ফলো করছেন ?” হ্যাঁ, সে কোন এক গলি দিয়ে চিরকালের মতো হারিয়ে গেল।
কলকাতার অটোর ঝগড়া: একদিন কি এক তুচ্ছ কারনে দুই যাত্রীর অটোর ঝগড়া। প্রবীণ ও নবীনে। আমি ছেলেটিকে বললাম – আচ্ছা আমাদের মূল সমস্যা কিন্তু অটো, কলকাতা, কলকাতার লোক নয়। ধরো আজকে যদি তোমাকে বা সেই ভদ্রলোককে চাকরী বা কাজের জন্য বেরোতে না হত, তবে দেখার সম্ভাবনাই ছিল না। আমাদের যদি এরকম বন্দোবস্ত হত যে এই অটোয় অফিসে গিয়ে বসের মুখে দেখার বদলে গোয়ার চার্টার্ড ফ্লাইটে এয়াহোষ্টেসের ওয়েলকাম ড্রিংক আর পরে বীচে “ফুলটুস মস্তি” ! তুমি কি এর সঙ্গে ঝগড়া করতে ? ছেলেটি কিছু বলল না, একটু ভেবে বলল, এবার হেসে – আমি গোয়া না গিয়ে কিন্তু মন্দারমণি যাব।
ব্যথা কমানোর সেলসম্যান : “উঠতে গেলে লাঠি আর বসতে গেলে মাটি”
ছুটির দিনগুলি : উত্তর কলকাতার এক দোকানে কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করলাম : আপনাদের ছুটি কবে ? উত্তর : “দোলে, না এলে আর ম’লে”
WBMS : তখন সল্টলেকের কোন এক পার্কের কাছে এক চা-ওয়ালার কাছে চা খেতে গিয়ে দোকানী বলছে – “জানিস, আমি কত বড়ো সংঘটনের মাননীয় সদস্য ?” কোন সংঘটন ? উত্তর : ওয়েষ্ট বেঙ্গল মাতাল সমিতি।
প্রবাসী পুত্রদের বিরক্ত পিতা : সল্টলেকের একটি বাজারের ভেতরের সেলুন। এক বৃদ্ধ দাড়ি কামাচ্ছেন। ছোকরা নাপিতটি রসিক – সে বললে – কাকীমার শরীর ঠিক আছে ত? আরে, ঠিক নেই, আমি আর একা কত দেখব ? ছেলেগুলো আসেই না (দু্ই ছেলেই প্রবাসী, অতি মেধাবী ও প্রতিষ্ঠিত)। বুঝলি এখন ভাবি, এদের এত লেখাপড়া না শেখালেই হয়তো ভালো ছিল। পরে, নাপিতটি আমায় বলল : “বৃুড়ো-বুড়িকে গ্যারেজ করে দিয়েছে।”
পুরোনো কমিউনিষ্ট বাঙ্গালী বৃদ্ধ : আমেরিকা প্রবাসী পুত্র-পুত্রবধুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ সফল বাঙ্গালী পিতা। আমি প্রশ্ন করলাম – আচ্ছা, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অবস্থা কিরকম দেখলেন ? অবস্থা কিরকম ? “ধুর, অসব কমবয়সের কথা ছাড়ো ত। এই দ্যাখো – মোজারেলা চীজ, খাও, একদম ওরিজিনাল মাল। চেখে দ্যাখো। আমি বল্লাম – “বহোত খুব ! শুধু একটু সাম্রাজ্যবাদের গন্ধ আসছে।” বৃদ্ধ অট্টহাস্যে তার যৌবনের অবিমৃষ্যকারিতাকে উড়িয়ে দিলেন।
পলাশবন্ধু